December 22, 2024, 8:22 pm
দৈনিক কুষ্টিয়া প্রতিবেদক/
শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি না মেনেই চালু হয়েছে আকিজ বিড়ি কারখানা। চাকরি বাঁচানো যায়নি দাবি দাওয়া নিয়ে উচ্চকিত ১৯জন শ্রমিকের। তবে, সবগুলো মজুরি বই অনুমোদন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রবেশের সময় বাড়িয়েছে একঘণ্টা। আর কারখানার ভেতরে বিড়ি বাঁধার পরিমাণ দিনে ১০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার করার দাবি মানেনি মালিকপক্ষ। তবে, কারখানার বাইরে ঠোস বানানোর ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে তারা।
গত ৯ জানুয়ারি দৌলতপুর উপজেলার হোসেনাবাদে অবস্থিত আকিজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আকিজ বিড়ি কারখানার বেশ কয়েকজন শ্রমিক সময়মতো কারাখানায় উপস্থিত হতে না পারায় তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়না। এ সময় কারখানার নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বাগবিতন্ডার একপর্যায়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। কারখানা কর্তৃপক্ষ দৌলতপুর থানায় খবর দেন। পরে পুলিশ গিয়ে শ্রমিকদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এতে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এ সময় শ্রমিক-পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। পরে হোসেনাবাদ বাজার সংলগ্ন কুষ্টিয়া-প্রাগপুর সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনরত শ্রমিকরা। ওইদিন দুপুর পর্যন্ত উপজেলার প্রধান এই সড়কটি টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুড়ি ফেলে অবরোধ করে রাখা হয়। হোসেনাবাদে এসে আন্দোলনে যোগ দেন উপজেলার ফিলিপনগরে অবস্থিত আকিজের আরেকটি বিড়ি কারখানার শ্রমিকরাও। দুই কারাখানার শ্রমিকরা একাট্টা হয়ে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।
এ ঘটনার পর বিড়ি কারখানা দুটি বন্ধ ঘোষণা করেন আকিজ কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েন। এরপর শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া ও কারাখানা খোলার ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন মালিকপক্ষ এবং শ্রমিকপক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করেও সমঝোতায় পৌঁছতে পারেনি। পরে কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সরওয়ার জাহান বাদশাহ কারাখানা খোলার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন। দেশের বাইরে থাকায় তিনি প্রতিনিধি পাঠিয়ে সমঝোতা করে দেন।
সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি প্রকৌশলী জিয়াউল কবীর সুমন, কারখানার ম্যানেজার আরিফুর রহমান, দৌলতপুর থানার ওসি তদন্ত শাহাদাৎ হোসেন, উপজেলা প্রশাসনের প্রতিনিধি এসি ল্যান্ড আজগর আলী এবং শ্রমিকদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করেই সমঝোতার ভিত্তিতে ২৬ জানুয়ারি কারখানা খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি প্রকৌশলী জিয়াউল কবীর সুমন বলেন, আমরা ফ্যাক্টরি ভিজিটও করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, শ্রমিকরা এখন খুশি। ১৭দিন কারখানা বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা আর্থিক অনটনে পড়েছিলো প্রায় ৮ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকরা বলেছেন, আর কারখানা বন্ধের আন্দোলনে যাবেন না তারা। প্রয়োজন হলে তারা দাবি দাওয়া জানাবে, কিন্তু কারখানা বন্ধের আন্দোলনে যাবে না।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রতিনিধি প্রকৌশলী জিয়াউল কবীর সুমন বলেন, শ্রমিকদের বেশিরভাগ দাবি দাওয়াই মেনে নিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। তবে সিন্ডিকেট করে কারখানা বন্ধের জন্য দায়ী উল্লেখ করে ১৯ জন শ্রমিকের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে ছিলো মালিক পক্ষ। তারা বলেছে, প্রয়োজনে এই কারখানা চালাবো না, তারপরও ওইসব কর্মীকে নেয়া হবে না। এই পরিস্থিতিতে বাকী শ্রমিকরা ওই ১৯ জনের সঙ্গে কথা বলে কাজে যোগ দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। শীতে সকাল ৭টার মধ্যে কারখানায় প্রবেশ করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শ্রমিকদের দাবি ছিলো সময় বাড়ানো। মালিক পক্ষ এ দাবি মেনে নিয়ে কারখানায় প্রবেশের শেষ সময় সকাল ৮টা নির্ধারণ করেছে- বলছিলেন প্রকৌশলী জিয়াউল কবীর। যেসব শ্রমিকের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তারা ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যায়নপত্র দিয়ে মজুরি খাতা নিবন্ধন করেছিলেন। আকিজ বিড়ির মালিকপক্ষ জাতীয় পরিচয়পত্রছাড়া সব মজুরিখাতা বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন শিশুশ্রম এড়াতে তারা জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করতে চায়। শ্রমিকদের দাবির প্রেক্ষিতে এ ব্যাপারেও ২মাস সময় দিয়েছে মালিকপক্ষ। বলেছে, এসব মজুরি খাতা এখন চলবে, তবে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তাদের দুই মাসের মধ্যে তা নিয়ে আসতে হবে। প্রকৌশলী সুমন বলেন, এই খাতাতেই শ্রমিকদের বিড়ি বানানো এবং তার বিপরীতে টাকা তোলার হিসেব থাকে। অনেক শ্রমিকের ৬/৭টি করেও খাতা আছে। এরা নিজেরা বিড়ি বাঁধার কাজ না করে সহকারী দিয়ে বিড়ি তৈরি করতো আর কারখানায় প্রভাব বিস্তার করতো। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন একজনের একাধিক খাতা থাকবে না।
শ্রমিকদের আরেকটি দাবি ছিলো দিনে ১০ হাজারের স্থলে যেন ১৪ হাজার পর্যন্ত বিড়ি বাঁধতে দেয়া হয়। এতে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেত। কারণ প্রতি হাজারে ৪১ টাকা করে মজুরি দেয়া হয় শ্রমিকদের। ২/৩ দিন পর পর মজুরির টাকা তুলতে পারেন শ্রমিকরা। সমঝোতাকারী প্রকৌশলী জিয়াউল বলেন, মালিকপক্ষ বলেছে- তাদের আরো অনেক কারখানায় একই নিয়ম রয়েছে। এখানে বিড়ি বাঁধার লিমিট বাড়িয়ে দিলে অন্য সব কারখানায় অসন্তোস দেখা দেবে। তাই এই দাবি তারা মেনে নেয়নি।
শ্রমিকদের অন্যতম নেতা বিপ্লব হোসেন বলেন, কারখানার বাইরে বাড়িতে বিড়ির ঠোসা বানানোর ক্ষেত্রে একটি খাতায় ১০ হাজারের বেশি বিল দেয়া হতো না। এটা এখন উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে- যে যতটা সম্ভব করতে পারবে। এতে আমাদের সুবিধাই হয়েছে। এখানে প্রতি হাজারে ৫ থেকে ৬টাকার মধ্যে বিল দেয়া হয়।
বিপ্লব বলেন, কারখানার ভেতরে ১২শ থেকে ১৪শ শ্রমিক কাজ করে। এদের মধ্যে ৩০জনকে বাদ দিয়েছিলো মালিকপক্ষ। তারা হাঙ্গামা করে এমন অভিযোগ কারখানা কর্তৃপক্ষের। এখান থেকে ১৯ জনকে নেয়ইনি তারা, সমঝোতার ভিত্তিতে বাকী ১১জনকে নেয়া হয়েছে। মজুরি বৃদ্ধির ব্যাপারে মালিকপক্ষ ভেবে একমাস সিদ্ধান্ত দেবে বলে জানিয়েছে- বলেন বিপ্লব। শ্রমিক নেতা বিপ্লব বলেন, আমাদের কিছুই করার নেই, কাজ না থকেলে খাবার জোটেনা। তাই যতটুকু দাবি মেনেছে মালিকপক্ষ তাতে আমাদের খুশি থাকতে হচ্ছে।
দৌলতপুর থানার ওসি (তদন্ত) শাহাদাৎ হোসেন বলেন, দুুই সপ্তাহেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পর পুনরায় কারাখানা দুটি খুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের বিবাদমান পরিস্থিতি নিরসন হবে বলে তিনি মনে করেন।
দৌলতপুর উপজেলার হোসেনাবাদে আকিজের এই বিড়ি কারাখানায় শ্রমিক অসন্তোসের ঘটনা নতুন নয়। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের দাবি দাওয়া উপেক্ষা করায় প্রায়ই সেখানে শ্রমিক অসন্তোসের ঘটনা ঘটে। দাবি আদায়ের লক্ষে শ্রমিকরা কাজ ফেলে আন্দোলনে রাস্তায় নেমে এসেছেন বহুবার। সেখানে সবচেয়ে বড় শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দেয় ২০১২ সালের ১৫ জুলাই। সেইদিন কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান। তাদের গুলিতে মিন্টু (২২) ও রাকিবুল (২৫) নামে দুই শ্রমিক নিহত হন। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শ্রমিকরা ব্যাপক বিক্ষোভ করেন। শ্রমিকদের দাবি আদায়ের আন্দোলনের মুখে বেশ কিছুদিন কারাখানাটি অচল হয়ে পড়ে। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের সমঝোতার মাধ্যমে পুনরায় কারখানা চালু হয়।
Leave a Reply